বাংলাদেশে প্রচলিত জনপ্রিয় ভেষজ উদ্ভিদ ও তাদের ব্যবহার - ভাইরাল ভাবী

শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯

বাংলাদেশে প্রচলিত জনপ্রিয় ভেষজ উদ্ভিদ ও তাদের ব্যবহার

বাংলাদেশে প্রচলিত জনপ্রিয় ভেষজ উদ্ভিদ ও তাদের ব্যবহার


বাংলাদেশে ভেষজ উদ্ভিদ বহু প্রাচীনকাল থেকে চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রায় এর গভীর প্রভাব রয়েছে। বর্তমানে আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি ভেষজ চিকিৎসার গুরুত্বও বেড়ে চলেছে। কিছু জনপ্রিয় এবং সহজলভ্য ভেষজ উদ্ভিদ, যেমন তুলসী, নিম, অশ্বগন্ধা প্রভৃতির বিভিন্ন গুণাগুণ রয়েছে, যা প্রাকৃতিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ও সুস্থ থাকার ক্ষেত্রে সহায়ক।


তুলসী (Ocimum sanctum)


পরিচিতি:
তুলসী একটি পবিত্র ও ঔষধি উদ্ভিদ হিসেবে সুপরিচিত। এটি মূলত 'হলি বাসিল' নামেও পরিচিত এবং বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি ঘরেই তুলসীর গাছ পাওয়া যায়। তুলসীর দুইটি প্রধান প্রজাতি রয়েছে—শ্বেত তুলসী ও কৃষ্ণ তুলসী। উভয় প্রকারই ঔষধি গুণে সমৃদ্ধ।

গুণাগুণ:
১. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি: তুলসী শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এতে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান, যা শরীরের রোগজীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে।
২. শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা দূরীকরণ: সর্দি-কাশি, হাঁপানি এবং ব্রংকাইটিসের মতো শ্বাসযন্ত্রের সমস্যায় তুলসী অত্যন্ত কার্যকর। তুলসীর পাতা এবং এর রস গলা ও শ্বাসনালীর প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
৩. মানসিক চাপ কমাতে সহায়ক: তুলসীর মধ্যে রয়েছে অ্যাডাপটোজেন, যা শরীরে মানসিক চাপ কমাতে এবং মানসিক স্বস্তি বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৪. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: তুলসী ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যও উপকারী। এটি ইনসুলিনের উৎপাদন বৃদ্ধি করে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
৫. চর্মরোগ প্রতিকার: তুলসীর তেল ও রস ত্বকের সমস্যা, যেমন ব্রণ, এলার্জি এবং ফাংগাল ইনফেকশন প্রতিরোধে কার্যকর।

ব্যবহার:
- তুলসীর পাতা দিয়ে চা তৈরি করে খেলে সর্দি-কাশি থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
- তুলসীর পাতা চিবিয়ে খেলে মুখের ভেতরের ক্ষত এবং মাড়ির ইনফেকশন ভালো হয়।
- এর তেল মাথার ত্বকে ম্যাসাজ করলে চুলের খুশকি দূর হয়।

নিম (Azadirachta indica)


পরিচিতি:
নিম গাছকে বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঔষধি গাছ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিম গাছের পাতা, বাকল, বীজ এবং তেল সবই ঔষধি গুণসম্পন্ন। এটি প্রাচীনকাল থেকে গ্রামীণ চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।

গুণাগুণ:
১. অ্যান্টিসেপ্টিক ও অ্যান্টি-ব্যাকটেরিয়াল গুণ: নিমের মধ্যে প্রাকৃতিক অ্যান্টিসেপ্টিক গুণ রয়েছে, যা ত্বকের নানা সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক। নিম ত্বকের ফাংগাল ইনফেকশন এবং ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন দূর করতে কার্যকর।
২. ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ: নিম রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে, যা ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপকারী।
৩. চুল পড়া রোধ ও খুশকি প্রতিরোধ: নিমের তেল বা পাতা চুলে ব্যবহার করলে চুল পড়া রোধ হয় এবং খুশকি দূর হয়।
৪. পাচনতন্ত্রের সমস্যা সমাধান: নিমের পাতা খেলে অন্ত্রের সংক্রমণ এবং হজমের সমস্যা কমে যায়। এটি পাকস্থলীর নানা সমস্যা দূর করতেও সহায়ক।
৫. মশা ও কীটপতঙ্গ প্রতিরোধ: নিমের তেল বা ধোঁয়া মশা ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ প্রতিরোধে কার্যকর।

ব্যবহার:
- নিম পাতা পানিতে সেদ্ধ করে সেই পানি দিয়ে গোসল করলে ত্বকের বিভিন্ন ইনফেকশন দূর হয়।
- নিমের তেল চুলে লাগিয়ে রেখে কয়েক ঘণ্টা পর ধুয়ে ফেললে খুশকি ও চুলকানি দূর হয়।
- নিমের পাতা চিবিয়ে খেলে বা নিমের রস পান করলে শরীরের অভ্যন্তরীণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে থাকে।

অশ্বগন্ধা (Withania somnifera)


পরিচিতি:
অশ্বগন্ধা একটি সুপরিচিত ভেষজ উদ্ভিদ যা মূলত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়। এটি শারীরিক ও মানসিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এটি 'ইন্ডিয়ান জিনসেং' নামেও পরিচিত।

গুণাগুণ:
১. শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি: অশ্বগন্ধা শারীরিক শক্তি ও সহনশীলতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। এটি ক্লান্তি ও দুর্বলতা দূর করে এবং কর্মক্ষমতা বাড়ায়।
২. মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য: অশ্বগন্ধা মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতে সহায়ক। এটি কর্টিসল নামক স্ট্রেস হরমোনের মাত্রা কমায়।
৩. রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: অশ্বগন্ধা রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখতে এবং হৃদপিণ্ডের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৪. ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালীকরণ: এটি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং সর্দি-কাশি থেকে মুক্তি দেয়।
৫. মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি: অশ্বগন্ধা মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে এবং স্মৃতিশক্তি উন্নত করে।

ব্যবহার:
- অশ্বগন্ধার শিকড় থেকে গুঁড়ো তৈরি করে দুধের সঙ্গে মিশিয়ে খেলে শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি পায়।
- মানসিক চাপ কমাতে অশ্বগন্ধার নির্যাস ব্যবহার করা যেতে পারে।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য অশ্বগন্ধার গুঁড়ো নিয়মিত পান করতে পারেন।

অন্যান্য ভেষজ উদ্ভিদ


বাংলাদেশে তুলসী, নিম ও অশ্বগন্ধা ছাড়াও আরও অনেক ভেষজ উদ্ভিদ প্রচলিত রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্ভিদ হলো—

আদা (Zingiber officinale):

আদা একটি বহুল ব্যবহৃত ভেষজ উদ্ভিদ। এটি পেটের সমস্যা, ঠাণ্ডা লাগা এবং গলাব্যথা থেকে মুক্তি পেতে সহায়ক। এছাড়াও আদার অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি গুণাবলী বিভিন্ন প্রদাহজনিত সমস্যা কমাতে কার্যকর।

বেল (Aegle marmelos):

বেল ফল ডায়রিয়া, ডিসেন্ট্রি এবং কোষ্ঠকাঠিন্য নিরাময়ে অত্যন্ত কার্যকর। বেলের শরবত শরীরকে শীতল রাখে এবং পেটের নানা সমস্যা দূর করে।

মেহেদি (Lawsonia inermis):

মেহেদি গাছের পাতা মূলত চুলের যত্নে ব্যবহৃত হয়। এটি চুলের রঙ পরিবর্তন, খুশকি দূর এবং চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখতে সহায়ক।

অ্যালোভেরা (Aloe vera):

অ্যালোভেরা ত্বকের যত্নে বহুল ব্যবহৃত। এটি ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখতে এবং চুলের পরিচর্যায়ও ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, এটি পেটের সমস্যা সমাধানে সহায়ক।

উপসংহার

বাংলাদেশে ভেষজ উদ্ভিদগুলোর বহুমুখী ব্যবহার আমাদের প্রাকৃতিক চিকিৎসা পদ্ধতির সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে প্রতিফলিত করে। তুলসী, নিম, অশ্বগন্ধা, আদা, বেল ইত্যাদি উদ্ভিদ শুধু সহজলভ্য নয়, এদের মধ্যে অসংখ্য রোগ নিরাময়ের গুণাবলী রয়েছে। এগুলোর সঠিক ব্যবহার শুধু গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নয়, শহরাঞ্চলেও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। আধুনিক চিকিৎসার পাশাপাশি ভেষজ চিকিৎসা আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে থেকে যাবে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ