ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার: প্রাচীন আর্যবেদ বনাম আধুনিক বিজ্ঞান - ভাইরাল ভাবী

শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯

ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার: প্রাচীন আর্যবেদ বনাম আধুনিক বিজ্ঞান

ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার: প্রাচীন আর্যবেদ বনাম আধুনিক বিজ্ঞান

ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার পৃথিবীর প্রাচীনতম চিকিৎসা পদ্ধতিগুলোর মধ্যে একটি। আর্যবেদ, যা ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্র, বহু শতাব্দী ধরে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহার করে রোগ নিরাময় করেছে। আধুনিক বিজ্ঞানও ভেষজ উদ্ভিদের উপাদানগুলো নিয়ে গবেষণা চালাচ্ছে এবং কিছু উদ্ভিদ থেকে কার্যকরী ওষুধও তৈরি হয়েছে। আর্যবেদ এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মধ্যে উদ্ভিদ নির্ভর চিকিৎসার ব্যবহারে কিছু মিল থাকলেও পদ্ধতি ও দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। এই নিবন্ধে আর্যবেদ ও আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহারের পার্থক্য ও মিল এবং কিছু উদ্ভিদ কীভাবে আধুনিক ওষুধে রূপান্তরিত হয়েছে তা আলোচনা করা হবে।



আর্যবেদে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহারঃ 

আর্যবেদিক চিকিৎসা পদ্ধতি মূলত প্রাকৃতিক উপাদান নির্ভর। এই শাস্ত্রে মানুষের শরীর, মন ও আত্মার মধ্যে একটি গভীর সম্পর্ক স্থাপন করা হয়েছে, এবং রোগ নিরাময়ের জন্য এই তিনটির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করা হয়েছে। এর চিকিৎসা পদ্ধতিতে উদ্ভিদ, শাকসবজি, খনিজ পদার্থ ও প্রাণীজ দ্রব্যের ব্যবহার করা হয়। 

আর্যবেদের মূল লক্ষ্য রোগের উপসর্গ দূর করা নয়, বরং রোগের মূল কারণ নিরাময় করা। আর্যবেদে বিশ্বাস করা হয়, মানুষকে প্রাকৃতিক জীবনধারা অনুসরণ করতে হবে, যাতে তার শরীরে কোনো রোগ না বাসা বাঁধতে পারে। এখানে বিভিন্ন ভেষজ উদ্ভিদ যেমন তুলসি, অশ্বগন্ধা, হলুদ, নিম ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়। উদাহরণস্বরূপ, তুলসিকে একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং জীবাণুনাশক হিসেবে গণ্য করা হয়, যা শরীরকে বিষমুক্ত করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়।

আধুনিক বিজ্ঞানে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহারঃ 

আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান রোগ নিরাময়ে ভেষজ উদ্ভিদকে কেবলমাত্র একটিমাত্র উপাদান হিসেবে দেখে না, বরং তার রাসায়নিক গঠন ও ক্রিয়া প্রক্রিয়া বিশ্লেষণ করে। গবেষণাগারে ভেষজ উদ্ভিদ থেকে কার্যকরী যৌগ পৃথক করে তার প্রভাব পরীক্ষা করা হয়। আধুনিক বিজ্ঞান উদ্ভিদের ব্যবহারের পেছনে বৈজ্ঞানিক কারণ ও প্রমাণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করে এবং সেই অনুযায়ী ওষুধ তৈরি করে।

আর্যবেদ ও আধুনিক বিজ্ঞানে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহারে পার্থক্য

১. দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য:  
আর্যবেদ একটি সমগ্রবাদী (holistic) পদ্ধতি অনুসরণ করে, যেখানে রোগীর মানসিক, শারীরিক এবং আধ্যাত্মিক দিকগুলো বিবেচনায় রাখা হয়। আধুনিক বিজ্ঞান, অন্যদিকে, রোগের নির্দিষ্ট কারণ খুঁজে তা দূর করার চেষ্টা করে।

২. চিকিৎসার পদ্ধতি:  
আর্যবেদে উদ্ভিদকে সম্পূর্ণরূপে ব্যবহার করা হয়, যেমন গাছের মূল, পাতা, বীজ ইত্যাদি। আধুনিক বিজ্ঞানে, উদ্ভিদ থেকে নির্দিষ্ট রাসায়নিক যৌগ পৃথক করে তা দিয়ে ওষুধ তৈরি করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, উইলো গাছের বাকল থেকে স্যালিসিলিক অ্যাসিড পাওয়া যায়, যা অ্যাসপিরিন তৈরির মূল উপাদান।

৩. উদ্ভিদের ব্যবহার ও গবেষণা:  
আর্যবেদে উদ্ভিদের গুণাবলি মূলত প্রাচীন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার মাধ্যমে জানা গেছে এবং সেই অনুযায়ী তাদের ব্যবহার করা হয়। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান উদ্ভিদের রাসায়নিক উপাদান বিশ্লেষণ করে এবং তার প্রমাণিত কার্যকারিতার ওপর ভিত্তি করে ওষুধ তৈরি করে। উদাহরণস্বরূপ, আর্যবেদে হলুদকে প্রদাহরোধী ও অ্যান্টিসেপ্টিক হিসেবে ব্যবহৃত হয়, আধুনিক বিজ্ঞানেও হলুদের সক্রিয় উপাদান কারকিউমিনের প্রদাহরোধী গুণাগুণ প্রমাণিত হয়েছে।

৪. পূর্বাবস্থা বনাম আধুনিক গবেষণা:  
আর্যবেদিক চিকিৎসা কোনো পরীক্ষা-নিরীক্ষার উপর নির্ভর না করে বহু প্রাচীন জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞান পরীক্ষাগারে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে উদ্ভিদ উপাদানের কার্যকারিতা পরীক্ষা করে প্রমাণিত ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা প্রদান করে।

কিছু উদ্ভিদের আধুনিক ওষুধে রূপান্তর

১. রাউলফিয়া (Rauwolfia serpentina):
আর্যবেদে রাউলফিয়া স্নায়ুজনিত সমস্যা এবং উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হয়। আধুনিক বিজ্ঞানও এর মূল উপাদান, রিসার্পিন (reserpine), থেকে উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ তৈরি করেছে। রিসার্পিনের প্রভাবে কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের উত্তেজনা কমে যায়, ফলে রক্তচাপ কমে।

২. আকোনাইট (Aconitum):
আর্যবেদে আকোনাইটের ব্যবহার বিষধর সাপ বা পোকামাকড়ের কামড়ের জন্য করা হতো। আধুনিক চিকিৎসায়, এর সক্রিয় উপাদানগুলো থেকে পেশী শিথিলকারী ও ব্যথানাশক ওষুধ তৈরি হয়েছে। তবে এটি অত্যন্ত বিষাক্ত হওয়ায় সঠিক মাত্রায় ব্যবহারের প্রয়োজন।

3. আলোয় ভেরা (Aloe Vera):
আলোয় ভেরা গাছের পাতা থেকে পাওয়া জেল আর্যবেদে ত্বকের জ্বালা ও প্রদাহ কমাতে ব্যবহার করা হয়। আধুনিক চিকিৎসায় আলোয় ভেরা ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা, যেমন পোড়া ক্ষত ও শুষ্ক ত্বক নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। এর ভেতরে থাকা ভিটামিন ও এনজাইম ত্বকের কোষ পুনরুজ্জীবিত করে এবং আরোগ্য প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে।

4. পেরিউইঙ্কল (Catharanthus roseus):
আর্যবেদে পেরিউইঙ্কল উদ্ভিদ ডায়াবেটিস এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যবহৃত হতো। আধুনিক চিকিৎসায়, পেরিউইঙ্কলের মূল উপাদান থেকে ভিনক্রিস্টিন (vincristine) ও ভিনব্লাস্টিন (vinblastine) তৈরি হয়েছে, যা লিউকেমিয়া ও লিম্ফোমার মতো ক্যান্সার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। 

আর্যবেদ ও আধুনিক বিজ্ঞান: উদ্ভিদের যৌথ ব্যবহার

ভেষজ উদ্ভিদের ক্ষেত্রে আর্যবেদ ও আধুনিক বিজ্ঞানকে একসঙ্গে ব্যবহার করে রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে নতুন পথ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। আজকের দিনে অনেক চিকিৎসক আর্যবেদিক ভেষজ চিকিৎসার পাশাপাশি আধুনিক ওষুধও ব্যবহার করছেন। উদাহরণস্বরূপ, ডায়াবেটিসের রোগীরা মধুমেহ চূর্ণের পাশাপাশি ইনসুলিনও গ্রহণ করেন। এতে প্রমাণিত হয়েছে যে, প্রাচীন আর্যবেদের জ্ঞান ও আধুনিক বিজ্ঞানের উন্নতি একে অপরের পরিপূরক হতে পারে।

আর্যবেদ এবং আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের মধ্যে ভেষজ উদ্ভিদের ব্যবহারে মৌলিক পার্থক্য থাকলেও উভয় ক্ষেত্রেই ভেষজ উদ্ভিদকে কার্যকরী উপায়ে রোগ নিরাময়ে ব্যবহার করা হয়েছে। আর্যবেদ রোগীর সার্বিক সুস্থতার ওপর গুরুত্বারোপ করে, যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান উদ্ভিদের রাসায়নিক উপাদানের কার্যকারিতা বিশ্লেষণ করে ওষুধ তৈরি করে। কিছু উদ্ভিদ আজকের দিনে আধুনিক ওষুধে রূপান্তরিত হয়েছে, যেমন রাউলফিয়া থেকে রিসার্পিন এবং পেরিউইঙ্কল থেকে ক্যান্সারের ওষুধ তৈরি হয়েছে। এই উদাহরণগুলো প্রমাণ করে যে প্রাচীন আর্যবেদের জ্ঞান এবং আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞান একসঙ্গে মানবজাতির কল্যাণে কাজে লাগানো সম্ভব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ