বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতি - ভাইরাল ভাবী

শুক্রবার, সেপ্টেম্বর ১৩, ২০১৯

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতি



ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতি হলো প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা একটি চিকিৎসা ব্যবস্থা যেখানে উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ ও প্রাকৃতিক উপাদান ব্যবহার করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতি বিভিন্ন ধরনের এবং প্রতিটি অঞ্চলের নিজস্ব ঔষধি উদ্ভিদ ও ব্যবহার পদ্ধতি রয়েছে। এই ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো চীনা হার্বাল মেডিসিন, ইউনানি চিকিৎসা, আয়ুর্বেদ এবং ওয়েস্টার্ন হার্বালিজম। প্রতিটি পদ্ধতি একটি বিশেষ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের মধ্যে গড়ে উঠেছে এবং আজও মানুষের চিকিৎসায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১. চীনা হার্বাল মেডিসিন

প্রাচীন পটভূমি ও ধারণা:
চীনা হার্বাল মেডিসিন (Traditional Chinese Medicine বা TCM) বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতির একটি। এর ইতিহাস প্রায় ৩০০০ বছরের পুরনো। এই চিকিৎসা পদ্ধতির মূল বিশ্বাস হলো, মানবদেহের সুস্থতা Yin ও Yang-এর মধ্যে সুষম ভারসাম্যের উপর নির্ভরশীল। জীবনীশক্তি, যাকে চীনা ভাষায় "Qi" বলা হয়, এটি মানবদেহে প্রবাহিত হয়। যদি Qi-এর প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়, তবে অসুস্থতা দেখা দেয়। 

ভেষজ উপাদান ও তাদের ব্যবহার:
চীনা হার্বাল মেডিসিনে বিভিন্ন উদ্ভিদ, খনিজ এবং পশুজাত উপাদান ব্যবহার করা হয়। সাধারণত ৫০০০-এরও বেশি ভেষজ উপাদান রয়েছে এই পদ্ধতিতে। এর মধ্যে অন্যতম হল গ্যানোডার্মা (Reishi মাশরুম), জিনসেং, গুজি বেরি, অ্যাঞ্জেলিকা, জিনকো বিলোবা, এবং মুলেনের শিকড়। 

ব্যবহার:
চীনা হার্বাল মেডিসিনে ভেষজগুলো বিভিন্ন ধরনের অসুস্থতার চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়, যেমন পরিপাকতন্ত্রের সমস্যা, মানসিক চাপ, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, হজমের উন্নতি, এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো। যেমন, জিনসেং শক্তি বাড়াতে এবং মানসিক তীক্ষ্ণতা বাড়াতে সহায়ক বলে বিশ্বাস করা হয়।

২. ইউনানি চিকিৎসা

ইতিহাস ও পটভূমি:  
ইউনানি চিকিৎসা প্রাচীন গ্রীক চিকিৎসা পদ্ধতির উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এর নামকরণ করা হয়েছে "ইউনান" শব্দ থেকে, যার অর্থ হলো গ্রীস। এই চিকিৎসা পদ্ধতির প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে হিপোক্রেটিসকে (Hippocrates) গণ্য করা হয়। পরবর্তীতে মুসলিম বিজ্ঞানীরা একে আরো উন্নত ও প্রভাবশালী করেন, বিশেষ করে ইবনে সিনা (Avicenna) এই ক্ষেত্রে বড় অবদান রেখেছেন।

মৌলিক ধারণা ও উপাদান:
ইউনানি চিকিৎসায় চারটি মূল শারীরিক তরলকে (হিউমর) গুরুত্ব দেওয়া হয়—সফরা (হলুদ পিত্ত), দম (রক্ত), সাওদা (কালো পিত্ত), এবং বালগাম (কফ)। স্বাস্থ্য তখনই ভালো থাকে যখন এই চারটি উপাদান সুষম অবস্থায় থাকে। 

ভেষজ উপাদান ও তাদের ব্যবহার:
ইউনানি চিকিৎসায় ব্যবহৃত ভেষজ ওষুধগুলির মধ্যে শিলাজিৎ, আসগন্ধ, চিরতা, সিননা, হালদি, কালো জিরা এবং বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ তেল ও খনিজ রয়েছে। এই ভেষজ উপাদানগুলো হজম সমস্যা, ত্বকের রোগ, যকৃতের অসুখ এবং নার্ভাস সিস্টেমের সমস্যা নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। 

বিশেষ চিকিৎসা পদ্ধতি:
ইউনানি চিকিৎসায় "ইলাজ-বিল-দাওয়াহ" (ঔষধি দ্বারা চিকিৎসা) এবং "ইলাজ-বিল-তাদবীর" (নিরাময়ের পদ্ধতি) নামে দুটি চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। দ্বিতীয় পদ্ধতিতে বিভিন্ন ধরণের থেরাপি ব্যবহার করা হয়, যেমন কাপিং থেরাপি (হিজামা), লেচ থেরাপি (জোঁক থেরাপি), এবং ভিন্ন ধরনের খাবারের নিয়ম।

৩. আয়ুর্বেদ

প্রাচীন পটভূমি ও ধারণা:
আয়ুর্বেদ ভারতের একটি প্রাচীন চিকিৎসা পদ্ধতি যার ইতিহাস প্রায় ৫০০০ বছর পুরনো। আয়ুর্বেদের মূল ধারণা হলো প্রতিটি মানুষের শরীরে তিনটি প্রধান দোষ (Vata, Pitta, Kapha) আছে, এবং এই দোষগুলোর ভারসাম্যই স্বাস্থ্য রক্ষার মূল চাবিকাঠি। দোষগুলির ভারসাম্যহীনতা হল অসুস্থতার মূল কারণ।

ভেষজ উপাদান ও তাদের ব্যবহার:
আয়ুর্বেদে ব্যবহৃত প্রধান ভেষজ উপাদানগুলির মধ্যে অশ্বগন্ধা, তুলসি, হলুদ, ব্রাহ্মী, আমলকি, নিম, এবং ত্রিফলা উল্লেখযোগ্য। প্রতিটি উপাদান বিভিন্ন ধরণের অসুস্থতা নিরাময়ে ব্যবহৃত হয়। যেমন, তুলসি কফ নিরাময়ে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে ব্যবহৃত হয়, আর অশ্বগন্ধা মানসিক চাপ ও অবসাদ কমাতে সাহায্য করে।

বিশেষ থেরাপি ও পদ্ধতি: 
আয়ুর্বেদে পঞ্চকর্ম নামে একটি বিশেষ থেরাপি রয়েছে, যা শরীরকে শুদ্ধ করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। এর মধ্যে পাঁচটি প্রধান পদ্ধতি রয়েছে—বমন (উল্টানো), বিসর্গ (পাকস্থলীর শুদ্ধি), বাস্তি (বিরেচন), নস্য (নাসার মধ্যে ঔষধ দেওয়া), এবং রক্তমোক্ষণ (রক্ত পরিষ্কার)।

৪. ওয়েস্টার্ন হার্বালিজম

ইতিহাস ও পটভূমি: 
ওয়েস্টার্ন হার্বালিজম (পাশ্চাত্য ভেষজ চিকিৎসা) মূলত ইউরোপ এবং উত্তর আমেরিকায় বিকাশ লাভ করেছে। এই পদ্ধতির শিকড় প্রাচীন গ্রীক ও রোমান চিকিৎসা পদ্ধতির সাথে যুক্ত, তবে এর আধুনিক রূপটি মূলত ১৮শ থেকে ১৯শ শতকের ইউরোপীয় ফোক মেডিসিন থেকে উদ্ভূত। ২০শ শতকে এই পদ্ধতি আরো বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমে সমৃদ্ধ হয়েছে।

ভেষজ উপাদান ও তাদের ব্যবহার:  
ওয়েস্টার্ন হার্বালিজমে ব্যবহৃত প্রধান উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে ক্যামোমাইল, ইচিনেসিয়া, পেপারমিন্ট, মিল্ক থিসল, এবং গোল্ডেনসিল। এই ভেষজগুলো সাধারণত ঠান্ডা, ফ্লু, পাচনতন্ত্রের সমস্যা, লিভারের অসুখ এবং ত্বকের রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়।

আধুনিক গবেষণা ও ব্যবহার:
ওয়েস্টার্ন হার্বালিজমে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ইচিনেসিয়ার ওপর গবেষণায় দেখা গেছে যে এটি ঠান্ডা এবং সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে। ক্যামোমাইলও মানসিক চাপ কমাতে এবং হজমের সমস্যা নিরাময়ে কার্যকরী বলে প্রমাণিত হয়েছে।

তুলনা ও সংযোগ

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতি বিভিন্ন হলেও তাদের মধ্যে কিছু সাধারণ ধারণা রয়েছে। বেশিরভাগ পদ্ধতিই শরীরের প্রাকৃতিক ভারসাম্যের দিকে মনোযোগ দেয় এবং প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে চিকিৎসা করে। যেমন, আয়ুর্বেদ ও চীনা হার্বাল মেডিসিন উভয়ই শরীরের ভিতরের শক্তির ভারসাম্যের ওপর গুরুত্ব দেয়, যেখানে ইউনানি চিকিৎসা শারীরিক তরলের ভারসাম্যের প্রতি মনোযোগ দেয়। 

পাশাপাশি, প্রতিটি পদ্ধতিতে উদ্ভিদের ঔষধি গুণাগুণের ওপর নির্ভরতা দেখা যায়। ওয়েস্টার্ন হার্বালিজম যেখানে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণায় মনোযোগী, সেখানে চীনা হার্বাল মেডিসিন ও আয়ুর্বেদে ভেষজ উপাদানের ঐতিহ্যবাহী ব্যবহারকে মূল ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়।

বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের ভেষজ চিকিৎসা পদ্ধতি মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং এখনো করছে। প্রাকৃতিক উপাদানের ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই চিকিৎসা পদ্ধতিগুলি সময়ের সাথে সাথে আধুনিক বিজ্ঞান ও গবেষণার সাথে যুক্ত হচ্ছে। তবে প্রতিটি পদ্ধতির মূল ধারণা একই রয়ে গেছে: প্রাকৃতিক উপাদান ও শরীরের

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় পোস্টসমূহ